বিজয়, আত্মত্যাগ আর সুবিধাবাদের গল্প ইয়াদ আল-কুনাইবি
বিজয়, আত্মত্যাগ আর সুবিধাবাদের গল্প
ইয়াদ আল-কুনাইবি
.
কল্পনা করুন, বিশাল প্রাসাদে বন্দী একদল মানুষ। বের হবার দরজা কেবল একটা। সে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। দরজা খুলতে চাবি লাগবে। প্রাসাদের ভেতরের এক পাশের দেয়ালে দশটা গর্ত। যেকোনো একটায় আছে দরজার চাবি। কোন গর্তে চাবি আছে সেটা কেউ জানে না। হিসেব খুব সহজ তাই না? গর্তগুলো খুঁজে খুঁজে চাবিটা খুঁজে বের করে নিলেই ল্যাঠা চুকে যায়।
.
হ্যাঁ, হিসেব সোজা। তবে একটা জটিলতা আছে। দশটা গর্তের একটার মধ্যে তো চাবি, কিন্তু বাকি নয়টার মধ্যে আছে বিষাক্ত কালকেউটে সাপ।
.
সহজ সমীকরণের এ জটিলতার কারণেই বুঝি কেউ সাহস করে আগাচ্ছে না। সবাই বসে আছে নিষ্ক্রিয় হয়ে। কেউ কেউ প্রাসাদের তুলনামূলক আরামদায়ক কোনো কোণা বেছে নিয়ে শুরু করে দিয়েছে বিছানাপাতি গোছানো। বন্দীত্বকেই যেন নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছে সবাই।
.
শেষমেশ একজন উঠে দাঁড়াল। চোখে ইস্পাতের দৃঢ়তা। আত্মবিশ্বাসী পায়ে হেঁটে গেল গর্তগুলোর কাছে। একটা গর্ত বেছে নিয়ে ভাবলেশহীন মুখে হাত ঢুকিয়ে দিল...সাপ ছোবল দিল। মানুষটা মারা গেল প্রায় সাথে সাথে।
.
উঠে দাঁড়াল আরও একজন। হাতে একটুকরো কাপড় পেঁচিয়ে নিল সতর্কতা স্বরূপ। সযত্নে এড়িয়ে গেল প্রথমজনের বাছাই করা গর্তটা। তারপর বাকি ৯টা থেকে বেছে নিল একটা গর্ত।
হাতের ওই টুকরো কাপড়ে তেমন একটা লাভ হলো না।
দ্বিতীয়জনও মারা পড়ল সাপের কামড়ে।
.
উঠে দাঁড়াল তৃতীয় আরেকজন। তারপর চতুর্থ, তারপর পঞ্চম। প্রত্যেকে সাধ্যমতো চেষ্টা করল সাপের ছোবল থেকে হাত বাঁচানোর। কিন্তু একে একে মারা পড়ল সবাই।
.
পুরো সময়টা জুড়ে অধিকাংশ মানুষ বসে থাকল নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে। সবার মুক্তির জন্য ওরা যখন একে একে মারা যাচ্ছিল, সেই সময়টা নিষ্ক্রিয় দর্শকরা কাটাচ্ছিল ঠাট্টা আর সমালোচনায়। কেউ ঠাট্টা করল, কেউ গাল দিল বোকা, গাধা, নির্বোধ, আবেগী আর জযবাতি বলে। ‘আর যাই হোক চাবি খোঁজার চেষ্টায় বেঘোরে প্রাণ দিতে হচ্ছে না’, এ তৃপ্তি নিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বসে রইল বাকিরা।
.
একে একে মারা পড়ল নয় জন।
গর্ত বাকি একটা।
.
হাত বাড়িয়ে শেষ গর্তটা থেকে চাবিটা বের করে আনল দশম জন। ধীর নিশ্চিন্ত পায়ে হেঁটে গিয়ে খুলে দিল প্রাসাদের দরজা। এতক্ষণের নিষ্ক্রিয় দর্শক আর সমালোচকরা তখন আনন্দে আত্মহারা। চারপাশে জড়ো হয়ে কান ফাটানো শব্দে হাততালি দিচ্ছে সবাই। কেউ আবেগে কাঁদছে। হাতে চাবি ধরা মানুষটাকে ভাসিয়ে দিচ্ছে প্রশংসার বন্যায়...
এবার কল্পনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসুন।
.
আপনার জন্য একটা প্রশ্ন আছে।
বলুন তো এ মুক্তি, এ বিজয় আসলে কে আনল?
এ বিজয় কি দশম ব্যক্তির অবদান? নাকি আগের নয় জনের অবদান আরও বেশি? সবার আগে যে মানুষটা উঠে দাঁড়িয়েছিল, নিঃশঙ্কচিত্তে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিল সাপের গর্তে, যারা তাঁর পর এসেছিল, তাদের তুলনায় তাঁর অবদান কি বেশি না?
.
আমাদের কল্পনার প্রাসাদের বন্দী মানুষগুলোর মতোই মুসলিম উম্মাহও আজ বন্দীত্বের সময় পার করছে। সত্যিকার অর্থে পরাজিত তো সে, ঝুঁকি নেয়ার চেয়ে বন্দী হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়া যার পছন্দনীয়। যে সাপের কামড়ের ভয়ে মুক্তির চেষ্টাই করে না।
.
কিন্তু যারা নিঃসংকোচে, নির্ভীক চিত্তে উঠে দাঁড়ায়। সব প্রতিকূলতা আর ঝুঁকি সত্ত্বেও মুক্তির জন্য, বিজয়ের জন্য যারা চেষ্টা চালায়। যারা বিজয় দেখে যেতে পারবে না জেনেও বিজয়ের জন্য আল্লাহ আযযা ওয়া জাল-এর রাস্তায় জানমাল সম্পদ উজাড় করে দেয়, তারাই হলো গৌরবের উত্তরসূরি। তাঁরাই উম্মাহর অগ্রবর্তী বাহিনী।
.
আপনিও এ বাহিনীর সদস্য হতে পারবেন। তবে দুটো শর্ত আছে,
এমন কোনো গর্তে হাত দিতে পারবেন না, শরীয়াহ এবং ইতিহাসের শিক্ষা যেগুলোর ব্যাপারে দেখিয়ে দিয়েছে যে সেখানে চাবি নেই।
যারা আপনার আগে গেছেন এবং ছোবল খেয়েছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে। তাঁরা যেখানে শেষ করেছেন শুরু করতে হবে সেখান থেকে। তাঁদের ভুলগুলো এড়িয়ে যেতে হবে। তাঁদের অভিজ্ঞতা গভীরভাবে অধ্যয়ন না করে শুধু সাহস, বীরত্ব ও উত্তম নিয়্যাত নিয়ে এগোলো হবে না। তা না হলে আপনি আবারও ওই গর্তেই দংশিত হবেন যে গর্ত থেকে এর আগে আপনার ভাই ছোবল খেয়েছেন। আর মুমিন এক গর্ত থেকে দুইবার দংশিত হয় না।
.
যদি এ দুই শর্ত মেনে এগিয়ে যান, তাহলে নিশ্চিত থাকুন, বিজয় আমাদের হবেই। যেখানে ঈমান আছে, সেখানে হতাশার কোনো সুযোগ নেই।
.
#আয়নাঘর
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন